Pages

Tuesday, September 27, 2016

RABIES



জলাতঙ্ক

জলাতঙ্ক মূলত একটি ভাইরাসজনিত মরণব্যাধি। এর ইংরেজী নাম র‌্যাবিস। এটি ল্যাটিন শব্দ। যার অর্থ ‘পাগলামী করা’। জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশু বা রোগীর আচরণ থেকেই এই নামকরণের সূত্রপাত। সাধারণত কুকুর, বিড়াল, শেয়াল, বেজি, বানর, চিকা ইত্যাদি গরম রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীই জলাতঙ্কের বাহক।জলাতঙ্ক আক্রান্ত যে কোন প্রাণীর কামড়,আচড় এমনকি এদের লেহনেও জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। বাংলাদেশে জলাতঙ্ক রোগের মূল কারণ জলাতঙ্ক আক্রান্ত কুকুর।এ রোগের লক্ষণ জল দেখলেই ভয় পাওয়া,জল খাওয়া বা পান করার সময় খাদ্য নালীর উর্ধভাগের মাংসপেশীতে ব্যথাসহ তীব্র সংকোচন হতে পারে। এ জন্যই এর নাম জলাতঙ্ক। এই জলাতঙ্কে আক্রান্ত হলে কুকুর এবং মানুষ উভয়েরই মৃত্যু অনিবার্য।তিনি জানান, একটু সচেতন হলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

জলাতঙ্ক রোগ ও এর লক্ষণ
 জলাতঙ্ক (Hydrophobia) এই রোগটির জন্য দায়ী Rabis নামক এক প্রকার ভাইরাস।এই ভাইরাস টি যখন কোন কুকুর বা ক্যানিস গোত্রের প্রাণীর মধ্যে প্রবেশ করে তখন প্রাণীটি কিছুদিনের মধ্যে তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ প্রাণীটি পাগলা হয়ে যায়। এবার যদি এই প্রাণীটি কোন মানুষকে কামড়ায় তাহলে ভাইরাসটি সেই ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে ও বিভিন্ন অস্বাভাবিক লক্ষণের প্রকাশ ঘটায়।যেমন-পেটে ব্যথা,স্নান করতে অনীহা ভাব,জ্বর,শরীরের পেশী টান,অতিরিক্ত থুতু বের হওয়া এবং এর প্রধান লক্ষণ হল জল বা কোন তরল দেখে আতঙ্কিত হওয়া।

লক্ষণ
আক্রান্ত প্রাণী উম্মাদের মতো সবাইকে এবং সব কিছু কামড়ানোর প্রবনতা, উদ্দেশহীন ভাবে ছোটাছুটি করা, মুখ থেকে অত্যধিক লালা নিঃসৃত হওয়া, ঘন ঘন ঘেউ ঘেউ বা বিড় বিড় শব্দ করা। এক পর্যায়ে গলার মাংস পেশিতে পক্ষাঘাত হওয়াতে ঘেউ ঘেউ করতে না পারা, হাপ টেনে শ্বাস নেওয়া। ক্ষেত্র বিশেষে এমন রোগের আক্রান্ত প্রানীর মধ্যে উত্তেজনা ভাব প্রকাশ না পেয়ে চুপচাপ থাকতে পারে এবং গৃহের এক কোনে ঘুমায় অনেক দিনের আক্রান্ত হলে।
রোগটি সুপ্তাবস্থায় মানুষের শরীরে থাকে এক মাস থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত। আতে আক্রান্ত মানুষ অন্য আক্রান্ত প্রানির মতো অন্য মানুষকে কামরাতে চায়, পানি দেখলে ভয় পায়, পানি পান করতে পারেনা এবং শ্বাস কষ্ট হয়,মুখ থেকে লালা পড়ে।

প্রতিকার
ইঞ্জেকশান রাবিপুর ০,৩,৭,১৪,২৮ এই পাঁচ দিনে মাংসপেশিতে নিতে হয়।

জলাতঙ্ক রোগ ও প্রতিকার
জলাতঙ্ক রোগ (র‌্যাবিস) বাংলাদেশের অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এ অবহেলিত রোগ বিভিন্ন প্রকার জীব-জন্তুর মাধ্যমে ছড়ায়। জলাতঙ্ক রোগ ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত একটি মারাত্মক রোগ। প্রায় সব ধরনের প্রাণীর এ রোগ হতে পারে। আক্রান্ত প্রাণীর কামড়ে বা আঁচড়ে মানুষ ও গবাদি পশুতে এ রোগ সংক্রমিত হয়। লক্ষণ প্রকাশ পাবার পর এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই এবং রোগীর মৃত্যু অনিবার্য (১০০%)।তবে এই মারাত্মক রোগ সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য।
গ্রীক পুরাণ বিজ্ঞান মতে চার হাজার বছর পূর্ব থেকে মানুষ ও জন্তু এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু অদ্যাবধি এ রোগ হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য কোন ঔষধ আবিষ্কৃত হয়নি। অতীতে জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের জন্য কোন ভ্যাকসিন ছিল না। ৬ জুলাই ১৯৮৫ সালে লুই পাস্তুর নামক এক ফরাসী বিজ্ঞানী জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন।
জলাতঙ্ক রোগের অস্তিত্ব বিশ্বব্যাপী। সারাবিশ্বে প্রতি বছর পঞ্চান্ন হাজারেরও বেশি মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যুবরণ করে থাকে। এর মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশসমূহ শতকরা ৯৫ ভাগ, তন্মধ্যে ৩১০০০ (৫৬%) মানুষ এশিয়া মহাদেশে ও ২০০০০ এর অধিক ভারতে প্রতিবছর জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়। কারণ এ সমস্ত এলাকার জনগণ তাদের গৃহপালিত জন্তুকে যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয় না। বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য হারে জলাতঙ্ক রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। সরকারি সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০০০ এর অধিক লোক জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়।
জলাতঙ্ক সাধারণত বিভিন্ন প্রজাতির জীব-জন্তু যেমন-কুকুর, নেকড়ে বাঘ, খেকশিয়াল, বেজি, বিড়াল, বাদুর, বানর প্রভৃতি এবং মানুষের রোগ। বাংলাদেশে প্রায় সব প্রাণী অর্থাৎ যাদের রক্ত উষ্ণ তারা জলাতঙ্ক রোগাগ্রস্ত হতে পারে। আক্রান্ত কুকুর, বিড়াল এবং অন্যান্য বন্য ও গৃহপালিত জন্তু কামড় দিলে জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। তবে সব কামড়ে বা আচড়ে জলাংতক রোগ হয় না। ক্ষতস্থানে সাথে সাথে সাবান ও এনটিসেপটিক দ্বারা ধৌত ও যাথাযথ প্রতিরোধক ভেকসিন ব্যবস্থা নিয়ে সহজেই এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়।তবে কারো জলাতঙ্ক রোগ দেখা দিলে মৃত্যু ১০০% নিশ্চিত।বাংলাদেশে শতকরা ৯১ ভাগ জলাতঙ্ক রোগ হয় আক্রান্ত কুকুরের কামড়ে। কামড় বা আচড় দেয়ার সপ্তাহ থেকে ৬ মাস পরে এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়।
এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের গ্রামীণ জনগণ বিশেষ করে ১৫ বছরের নিচে শিশু কিশোর ও বয়স্ক মানুষ এ রোগের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুরা জীব জন্তু নিয়ে খেলা করে এবং বয়স্কদের জীব জন্তু প্রতিহত করার ক্ষমতা থাকে কম। জন্তুর কামড় বা নখের আঁচড়ে জলাতঙ্ক রোগ ছড়ায়। একজন মানুষ জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হলে ক্ষতস্থানে ব্যথা করে এবং একই সঙ্গে জ্বর,মানসিক অবসাদ, অস্থিরতা, পানি দেখে ভয় পাওয়া, আলো বাতাস সহ্য করতে না পারা, শ্বাসকষ্ট ও সমস্ত শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে অবশেষে ভয়ংকর মৃত্যুবরণ করে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় জরিপ করে দেখা গেছে, জীবজন্তুর কামড়ের ব্যাপকতা প্রতি এক হাজার জনে ১৩ জন। তন্মধ্যে ৬-১০ বছর বয়সের শিশু কিশোরের হার সর্বাধিক অর্থাৎ ২৭.৬% এবং ৪১-৬০ বছর বয়ষ্ক মানুষের হার ১৬.৩%। শতকরা ৭০.৪ ভাগ পুরুষ এবং শতকরা ২৯.৬ ভাগ মহিলা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ৩৩.৩% ভ্যাকসিন গ্রহণ করে, ৬২.৫ ভ্যাকসিন গ্রহণ করে না এবং ৩.১% ভেকসিন সম্পর্কে অবহিত নয়। বেশিরভাগ মানুষ ভ্যাকসিন না নেয়ার কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা ও দরিদ্রতা। অজ্ঞতার কারণে জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা যথাযথভাবে করা যায় না।
২০০৯ সালে ঢাকাস্থ সরকারি সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ২০০৪-২০০৮ সনের অর্থাৎ মোট ৫ বছরের হাসপাতালে আগত রোগীদের ওপর এক পরিসংখ্যান করা হয়। উক্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিভিন্ন জন্তুর কামড়ে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উক্ত হাসপাতালে ২০০৪ সনে ২৬,৭৮৯ জন রোগী চিকিৎসার জন্য এসেছে এবং ২০০৮ সনে এসেছে ৩৫,৭৯৮ জন ২০০৪-২০০৮ সনে মোট বছরে ১,৪৯,৪৩৯ জন জীবজন্তুর কামড়ের রোগী আসে। জানুয়ারী ও এপ্রিল মাসে এ রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি। ৮৫% রোগী এই হাসপাতালে গ্রাম থেকে আসে। জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর গড়ে ২৫,০০০ কুকুর সকল সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃক নিধন করা হয়। শতকরা একশতভাগ আক্রান্ত রোগীকে উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারিভাবে এ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের কোন সু-ব্যবস্থা বা কর্মসূচী নেই। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ রোগ প্রতিরোধ কিংবা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেরি। অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির মতোই এটি একটি মারাত্মক রোগ।মৃত্যু ও আক্রান্তের হার এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও ইহা সার্বিকভাবে অবহেলিত।
বাংলাদেশে প্রধানত বে-ওয়ারিশ কুকুরের মাধ্যমে (৯১%) ও গৃহপালিত বিড়ালের মাধ্যমে (৫%) এ রোগ ছড়ায়।বে-ওয়ারিশ কুকুর নিধনের জন্য আধুনিক কোন ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের কুকুর নিধনের কর্মসূচি থাকলেও তা সচরাচর চোখে পড়ে না।তা ছাড়া জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্যও সরকারি বা বেসরকারি কোন উদ্যোগ দেখা যায় না।তবে ২০০৭ সালে প্রথম সরকারিভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে সীমিত আকারে ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রথম বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপিত হয়েছিল।তারই ধারাবাহিকতায় অতি সম্প্রতি জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার লক্ষ্যে কতিপয় এনজিও কর্তৃক বাংলাদেশ এন্টি র‌্যাবিস এসোসিয়েশন (বিএআরএ) নামে একটি সংগঠন তৈরি করা হয়েছে।
টিসিভি এর বর্তমান ডোজ ০.১ মিলি করে দুই বাহুতে ১ম দিন, ৩য় দিন, ৭ম দিন ও ২৮তম দিনে দিতে হয়। প্রাণীর কামড় খুব মারাত্মক হলে অর্থাৎ মাংসপেশীসহ গভীর কামড় দিলে টিসিভি এর সাথে র‌্যাবিস ইম্যুনো গ্লোবিওলিন দিতে হয়।
জলাতঙ্ক একটি ভয়ানক রোগ।এ রোগের কারণ আমাদের জানা আছে,প্রতিরোধের উপায় জানি। নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে চাই সমাজে সর্বস্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ।আমরা দেশ থেকে গুটি বসন্ত তাড়িয়েছি।চলুন আমরা সবাই মিলে এক পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যদি জলাতঙ্ক তাড়াতে পারে আমরাও নিশ্চয়ই পারবো।
(অধ্যাপক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন, পরিচালক, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও, লাইন ডাইরেক্টর, সিডিসি, স্বাস্থ্য অধিদফতর মহাখালী)

জলাতঙ্ক আক্রান্ত মানুষের লক্ষণ
  • কামড়ের জায়গায় ব্যথা ও চিনিচিন করে;
  • জ্বর, ঢোক গিলতে ব্যথা ও খিঁচুনি হয়;
  • পানি খেতে চায় না, পানি দেখলে ভয় পায়;
  • খুব ঘন চটচটে লালা ঝরে;
  • শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ রেগে যায়;
  • পরে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায় এবং পক্ষাঘাত দেখা দেয়।
কুকুর কামড়ানোর ১০ দিন পর (সাধারণত ৩ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যে) জলাতঙ্কের প্রথম লক্ষণগুলো দেখা দেয়৷ লক্ষণ প্রকাশের পূর্বে চিকিৎসা শুরু করতে হবে৷

জলাতঙ্ক আক্রান্ত কুকুরের লক্ষণঃ
  • জলাতঙ্ক রোগে কোনো কুকুর আক্রান্ত হলে পাগলের মতো আচরণ করা শুরু করে;
  • সামনে মানুষ বা পশু যাকেই পায় তাকেই কামড়াতে চেষ্টা করে;
  • সর্বক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে;
  • মুখ দিয়ে লালা পড়ে (লালার সাথে জীবাণু নির্গত হয়);
  • কুকুরটি খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং কয়েক দিনের মধ্যে মারা যায়;
  • কুকুর বা অন্য কোনো পশু কামড়ালে দিশেহারা না হয়ে কুকুরটিকে ঘেরাও করে পর্যবেক্ষণ করা উচিত;
প্রতিরোধ
  • পোষা কুকুর-বিড়ালকে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া উচিত;
  • যাদের (পশুডাক্তার, পশুব্যবসায়ী, পশুপালক) পশু কামড়ানোর সম্ভাবনা বেশি তাদের আগেই টিকা নেওয়া উচিত;
  • জলাতঙ্ক রোগাক্রান্ত প্রাণী কামড় দিলে বা সন্দেহ হলে টিকা নিতে হবে এবং কামড়ানোর স্থানটি দ্রুত ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং দ্রুত চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে;
  • ঔষুধ সেবন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে রেজিষ্টার চিকিত্সকের পরামর্শ নিন;

জলাতঙ্ক নিয়ে ভয় নেই ১৪ ইঞ্জেকশনের দিনও শেষ এ্যান্টি র‌্যাবিস ভ্যাকসিন রাবিপোর

কুকুর কামড়ালে নাভির চারদিকে চরম কষ্টদায়ক সেই ১৪ ইঞ্জেকশন দেয়ার দিন আর এখন নেই। নেই তিন থেকে দশ হাজার টাকা মূল্যের দুর্লভ সেই ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য পৌরসভায় দৌঁড়ঝাপ আর তদবির করার দিনও। কুকুরে কামড়ানো মানুষের পেটে কুকুরের বাচ্চা হওয়ার গুজবও নেই, আতঙ্ক নেই জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু যাতনারও। দেশের ৬৪টি জেলাতেই এখন খুব সহজে বিনামূল্যেই পাওয়া যাচ্ছে কুকুর কামড়ানোর সেই দুর্লভ এ্যান্টি র‌্যাবিস ভ্যাকসিন-‘রাবিপোর’। এ যেন এখন অনেকটাই ‘ডালভাত’। প্রয়োজন শুধু একজন চিকিৎসকের একটি প্রেসক্রিপশন। অথচ মাত্র ক’বছর আগেও কুকুরে কামড়ানো রোগী ও তার অভিভাবককে এই ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিয়ে কতটাই না ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে! মজার বিষয়, চিকিৎসা সেবায় বর্তমান সরকারের এ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও নগর-বন্দরের অনেক সচেতন মানুষ এখনও জানেন না সরকারের এই সাফল্যের কথা। তাই তো কুকুর কামড়ালে এখনও তারা ছুটছেন মেডিক্যাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা পৌরসভায়। সেখানে কেউবা পাচ্ছেন সঠিক পরামর্শ, কেউবা আবার দালাল-বাটপারদের খপ্পরে হচ্ছেন প্রতারিত। এ জন্য মাঠপর্যায়ে চাই সরকারীভাবে ব্যাপক প্রচার।
এই তো ক’বছর আগেও একটা সময় ছিল, যখন মানুষের মুখে মুখে গুজব ছিল মানুষকে কোন কুকুর কামড়ালে নাভির চারদিকে ১৪ ইঞ্জেকশন দিতে না পারলেই ওই মানুষের পেটে কুকুরের বাচ্চা জন্মে এবং একপর্যায়ে কুকুর কামড়ানো ওই মানুষ এবং কুকুর উভয়েরই মৃত্যু হয়। গুজব ছিল কুকুর কামড়ালে এলাকার সাতটা ইদারার (ইন্দারা) ভেতর মুখ ঢুকিয়ে রোগমুক্তি চেয়ে প্রার্থনা করলেই রোগ মুক্ত হতো মানুষ। এ ছাড়াও গাঁও-গেরামে কবিরাজ আর গ্রাম্য চিকিৎসকদের ঝাড়ফুঁক আর বটিকা সেবনের প্রচলন আজও বিদ্যমান। কিন্তু আসলে এসব কিছুই ছিল নিছক গুজব আর কুসংস্কার। নাভির গোড়ায় ১৪ ইঞ্জেকশন দেয়ার দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। বিকল্প এসেছে ভ্যাকসিন। ৫টি ইঞ্জেকশনে এক ডোজ। দাম তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা হলেও স্বল্প সরবরাহ এবং দুষ্পাপ্যতার কারণে সংগ্রহ করতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকাও লেগে যেত। আর যাদের সামর্থ্য নেই, সেই দরিদ্র মানুষরা সরকারী সরবরাহে ফ্রি পেতে ছুটত স্থানীয় পৌরসভা কিংবা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু সেখানে জুতোর তলা শেষ করলেও কাজ হতো না। ফলে অনেককেই জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হতো। কিন্তু সেসব দিন আজ সুদূর অতীত। নেই এখন আর সেই বিড়ম্বনা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানুষের এই ভোগান্তি আর দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে দুবছর হয় সরকারীভাবে বিনামূল্যে এই ভ্যাকসিন সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য নোভারটিস বাংলাদেশ লি: এর মাধ্যমে ভারত থেকে আমদানি করা হয় ভ্যাকসিন ‘রাবিপোর’। তারই আলোকে এই সুবিধা ভোগ করছেন দেশবাসী। দেশের প্রতিটি জেলাতেই এখন সিভিল সার্জনের অধীনে একটি করে জলাতঙ্কের টিকাদান কেন্দ্র আছে। সেখানে গেলেই বিনামূল্যেই মিলছে সেই টিকা।

জলাতঙ্ক প্রতিরোধে সচেতনতা
২৮ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। জলাতঙ্ক রোগটি খুবই ভয়াবহ। কুকুর, বিড়াল ও অন্য পশুর কামড় বা আঁচড় থেকে এ রোগ হয়। ১৮৮৫ সালে লুই পাস্তুর এ রোগের টিকা আবিষ্কার করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। প্রতিবছর জলাতঙ্ক রোগে বিশ্বে ৫৫ হাজার মানুষ মারা যায়, যার বেশির ভাগই শিশু। জলাতঙ্ক হয় রেবিস ভাইরাসের মাধ্যমে। এ ভাইরাস মস্তিষ্কের স্টেমের নিউক্লিয়াস এমবিগুয়সে আক্রমণ করে। মস্তিষ্কের এ অংশটি প্রশ্বাসে নিয়োজিত শরীরের বিভিন্ন অংশকে অতিরিক্ত উত্তেজনা থেকে দমন করে রাখে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সমন্বয় ঘটায়। কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণে এই কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে জলাতঙ্ক রোগী যখন পানি খেতে যায়, তখন তার গলা ও শ্বাসনালি উত্তেজনায় সংকুচিত হয়ে তীব্র ব্যথার অনুভূতি জাগায়। সেই সঙ্গে কিছু পানি শ্বাসনালি দিয়ে মূল শ্বসনতন্ত্রে ঢুকে অনবরত কাশি হয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ফলে পানি দেখলেই এসব রোগী ভয় পায়। তাই এ রোগের নাম জলাতঙ্ক। উল্লিখিত লক্ষণ ছাড়াও এ রোগে অসংলগ্ন আচরণ, আবোলতাবোল কথাবার্তা, দৈনন্দিন কাজ করতে না পারা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, শ্বাসকষ্ট এমনকি শ্বসনতন্ত্র অকেজোও হয়ে যেতে পারে। একবার এ রোগের লক্ষণ দেখা দিলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে, যা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তাই এ রোগ প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

কী করবেন
  • যেসব প্রাণীর আঁচড় বা কামড়ে জলাতঙ্ক হয়, যেমন-কুকুর, বিড়াল, শেয়াল প্রভৃতি থেকে সাবধান থাকা এবং তাদের সংস্পর্শে না আসা। বিশেষ করে বাচ্চাদের দূরে রাখা।
  • গৃহপালিত কুকুর-বিড়ালকে নিয়মিত টিকা দেওয়া।
  • রাস্তায় বেওয়ারিশ ও টিকা না দেওয়া কুকুর-বিড়াল মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা।
  • কুকুরে না কামড়ালেও আগে থেকে টিকা দেওয়া যায়। ০, ৭, ২১ অথবা ২৮তম দিনে তিন থেকে চারটি টিকা দিতে হবে। টিকা দেওয়ার প্রথম দিনকে ‘০’ ধরতে হবে। সবাই এ টিকা নিতে পারে।
  • কুকুর কামড়ালে ক্ষতস্থান সাবান পানি দিয়ে অন্তত ১০ মিনিট ধরে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। এরপর দিতে হবে পভিডন আয়োডিন। ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ, কাপড় বা অন্য কিছু দিয়ে কখনো ঢাকা যাবে না।
  • জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে এমন কুকুর বা অন্য পশু কামড় বা আঁচড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে টিকা নেওয়া উচিত। ০, ৩, ৭, ১৪ ও ২৮তম দিনে টিকা দিতে হয়। আগে বলা হতো, কোনো কুকুর কামড়ালে সেই কুকুরকে ১০ দিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং ১০ দিনের মধ্যে কুকুরটি মারা না গেলে টিকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন সে ধারণা সত্য নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ৫০০ জন জলাতঙ্ক রোগীর মধ্যে গবেষণা করে দেখা গেছে, এর মধ্যে ৭৫ জনের ক্ষেত্রেই দায়ী কুকুরগুলো দীর্ঘদিন জীবিত ছিল। তা ছাড়া সম্পূর্ণ সুস্থ কুকুরও জলাতঙ্কের জীবাণু বয়ে বেড়াতে পারে। বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সম্পূর্ণ সুস্থ পাঁচটি কুকুর মেরে সেগুলোর মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখেছেন, প্রতিটির মধ্যে ‘নেগরি-বডি’ রয়েছে, যা ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ করে। সুতরাং বাইরে থেকে আপাত সুস্থ দেখতে কুকুরের মধ্যেও জলাতঙ্কের জীবাণু থাকতে পারে। তাই কুকুরে কামড়ালে দেরি না করে টিকা নেওয়া উচিত। সঙ্গে দিতে হবে ইমিউনোগ্লোবিওলিন ইনজেকশন।
এই ইমিউনোগ্লোবিওলিন ইনজেকশন অবশ্য বেশ ব্যয়বহুল ও অপ্রতুল। জলাতঙ্কের টিকার দাম অনেক, সরবরাহও কম। উপজেলা পর্যায়ে তো নেই বললেই চলে। তাই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ জলাতঙ্কের টিকা নিতে পারে। অনেকে আবার সামর্থ্য থাকলেও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চায় না, ঘরে বসেই কলাপড়া, পানিপড়া কিংবা ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা করায়। এতে গ্রামগঞ্জের এক বিশাল জনগোষ্ঠী অগোচরেই এ রোগে মারা যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক সংগঠনসহ সবারই এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে হতে হবে আরও সচেতন।

1 Comments:

Who can confidently pick the best service among those listed on this site?
SEO for contractors

Post a Comment